আবারও আরেকটা ডিসক্লেইমার দিয়েই শুরু করছি লেখাটা, আমাদের আচরণের ‘কতটুকু জৈবিক এবং কতটুকু সাংষ্কৃতিক’ নিয়ে একটা পর্বটা লেখার পর মস্তিষ্কের গঠন এবং বিকাশ নিয়ে আরও বেশ কয়েকটা বই এবং নতুন গবেষণা পড়তে শুরু করেছিলাম। আর সে জন্যই দেরী হয়ে গেল এই লেখাটা দিতে। এই লেখাটার শিরোনাম থেকেই বোধ হয় বুঝতে পারছেন যে,আগের লেখাটার অকাল মৃত্যু ঘটেছে। ফরিদ ভাই প্রায়শঃই বলেন পরের পর্ব লেখার প্রতিজ্ঞা করে কোন লেখা শেষ করলে সেই লেখা নাকি আর কখনও ব্লগের আলো দেখে না।ওনার কথা পুরোপুরি ফলে না গেলেও কিছুটা তো গেলই। যারা ওই লেখাটাতে মন্তব্য করেছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানানোর জন্য। এখন বুঝতে পারছি আজকের আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার বিভিন্ন গবেষনা এবং দাবীগুলোকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন এবং বিকাশটা বোঝা খুব জরুরী। ব্যাপারটা অনেকটা সারা রাত রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ বলে চিৎকার করে ওঠার মতও বলতে পারেন। বিবর্তনীয়ভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কতটুকু নমনীয়তা বা স্থিতিস্থাপকতা ধারণ করতে সক্ষম বা মস্তিষ্কের মত এত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের বিকাশ কীভাবে ঘটেছে, আমাদের জন্মের আগে এবং পরে মস্তিষ্কের গঠন কীভাবে বদলায়, বংশগতিয় পরিবেশের সাথে তার মিথষ্ক্রিয়াটা ঠিক কীভাবে কাজ করে, এগুলো সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা না থাকলে খালি প্রান্তিক কিছু বিষয়ের চৌহদ্দিতে মাথা ঠুকরে মরতে হবে, তর্ক বিতর্কও চলতে থাকবে উপরে উপরে ভাসাভাসা ভাবেই। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার ভিতরে ঢুকতে হলে, এর মধ্যে কতটুকু বাজারে কাটতি বাড়ানোর জন্য লেখা ‘পপ বিজ্ঞান’ এবং কতটুকু সত্যিকারের বিজ্ঞান তা বুঝতে হলে মস্তিষ্কের গভীরে ঢোকা ছাড়া বোধ হয় গত্যন্তর নেই। চলুন এবার মনোবিদ্যা দিয়ে শুরু না করে মননের উৎপত্তিস্থল মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে দেখি কতদূর এগুনো যায়।
মস্তিষ্কের বিবর্তন নিয়ে লিখতে চাচ্ছি বহুদিন ধরেই কিন্তু কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। একে তো মস্তিষ্কের ব্যাপার স্যাপার বেশ জটিল,তার উপর আবার দেহের এই এনার্জিখেকো(দেহের ওজনের মাত্র শতকরা ২ ভাগ ওজনের অংগটিকে সচল রাখতে ২০% এনার্জি ব্যয় করতে হয় আমাদের), জিনখেকো(মানুষের জিনোমের প্রায় ২৩-২৫ হাজার জিনের ৭০% নাকি এক্সপ্রেসড হয় মস্তিষ্কে) ৩ পাউন্ডের নরম অংগটি সম্পর্কে আমরা এখনও অনেক কিছুই জানি না (১)। আসলে ব্যাপারটা এতখানি জটিল বলেই তো আমরা এ সম্পর্কে এখনও এত কম জানি! এ প্রসঙ্গে ডঃ শন ক্যারল তার এন্ডলেস ফর্মস মোষ্ট বিউটিফুল বইতে আইবিএম এর এক কম্পিউটার রিসার্চ সাইন্টিস্ট এর মজার এক উক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন,’ if the human brain was so simple that we could understand it, we could be so simple that we could not’. ( এই কথাটার বাংলা করতে পারছি না, কেউ করে দিলে উপকৃত হব)
তবে আশার কথা হচ্ছে গত এক দশকে এ বিষয়টা নিয়ে প্রায় কালবৈশাখীর গতিতে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী জীববিজ্ঞানী পিটার মিডাওয়ার দুঃখ করে বলেছিলেন, মানুষের মনের উন্মেষ নিয়ে গবেষণা করতে হলে আমাদের হাতে একটি মাত্র পথই খোলা আছে, আর তা হল দুটো মানুষের মধ্যে ব্যবহারের পার্থক্য নির্ধারণ করে তা থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। মাত্র তিন দশক আগের কথা; তার এই বক্তব্যের সাথে আজকের রিসার্চগুলোর পরিধি তুলনা করলেই কিন্তু বোঝা যায় গত তিন দশকে আমরা কতটা এগিয়ে গেছি। আজ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি হাতে হাত রেখে অকল্পনীয় গতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র দুই ব্যক্তির ব্যবহারের পার্থক্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে সিদ্ধান্ত টানার দিন ফুরিয়েছে। আমরা প্রথমবারের মত একদিকে যেমন পূর্ণাংগ জিনোমের খুঁটিনাটি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছি,ভ্রূণাবস্থায় বিভিন্ন জিনের এক্সপ্রেশন বা কর্মকান্ড ও বিকাশ প্রত্ক্ষ্য করছি, ঠিক তেমনিভাবে উঁকি মেরে দেখতে সক্ষম হচ্ছি আমাদের মস্তিষ্ক নামক রহস্যময় অংগটির ভিতরে। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তরই হয়তো অজানা রয়ে গেছে কিন্তু যে গতিতে আমরা আগাতে শুরু করেছি তা তে করে ‘আরো অনেকখানি’ জানতে হয়তো খুব বেশী দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
মস্তিষ্ক নিয়ে লিখতে গেলে আরেকটা কঠিন সমস্যার সম্মুখীণ হতে হয়। এমন সব বিষয় উত্থাপন করতে হয় যাকে শুধু ‘বোরিং’ বললে আসলে কমই বলা হবে। এ যেন শাখের করাত, ‘হিপোক্যম্পাস, থ্যালামাস বা এ্যমিগডালা কাহাকে বলে’, জাতীয় রসকষহীন গালভরা পাঠ্যবই মার্কা কথাবার্তাগুলো না লিখে যেমন আগানোও যায় না আবার এগুলো নিয়ে লিখতে বসলেই পাঠকের দূর্গতি তো অনেক পরের কথা,নিজের দূরাবস্থার কথা মনে করেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কেউ যেন হ্যারি পটারের সেই চেতনা-শুষে নেওয়া ভয়াবহ ডিমেন্টেটরদের মত দম শুষে নিয়ে আমার এই রক্তমাংসের দেহটাকে তেজপাতার মত ছিবড়ে বানিয়ে দিচ্ছে। তাই ভাবছি একটু অন্যভাবে শুরু করলে কেমন হয়, আলোচনার খাতিরে এখানে সেখানে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের গঠনের প্রসংগ আসলেও সেটাকে মূল আলোচনা হিসেবে আনা হবে না। মুক্তমনার ব্লগার নীল রদ্দুর ইতোমধ্যেই এই দূরহ কাজটায় হাত দিয়েছেন, তাই ভাবছি আমি আরও পথে পা বাড়াবো না। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের গঠন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়লে নীল রোদ্দুরের মস্তিষ্কে অনুরণন লেখাটি থেকেই দেখে নেওয়ার ব্যবস্থা করবো।
শীবের গীততো অনেকই হল চলুন এখন মূল প্রসঙ্গে ঢোকা যাক। ইংরেজি ভাষায় মুরগি কেন রাস্তা পার হল এ নিয়ে অসংখ্য কার্টুন, জোক্স এবং কমিক আছে। এরকম দু’জন মোরগ এবং মুরগির গল্প দিয়েই মানুষের মস্তিষ্কের গল্প শুরু করা যাক। সম্বোধনের সুবিধার জন্য তাদের নাম দেওয়া যাক আবুল এবং রহিমা।
মোরগ আবুল এবং মুরগি রহিমা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার এ পারে। রাস্তা পার হয়ে ওপারে যাবে তারা। দেখা গেল মুরগী রহিমা দুপায়ে দৌড়ে,প্রায় অর্ধ-উড়ন্ত অবস্থায় ওপারে পৌঁছে গেলেন। কিন্তু মোরগ আবুল কেমন যেন ইতস্তত করতে থাকলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাস্তাটি পার না হয়ে কেমন যেন বিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ।আবুল কেন রাস্তা পার হলেন না, তার সঙ্গিনী তড়তড় করে চলে যাওয়ার পরও উনি কেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন? উনি কী ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলেন না, নাকি উনি যা দেখছিলেন তার মাথমুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, নাকি রাস্তা কীভাবে পার হতে হয় সেই মেমরিটি হঠাৎ করেই তার মস্তিষ্কে আর আর কাজ করছিল না। এমনও তো হতে পারে যে, রাস্তা পার হওয়ার ইচ্ছার সাথে পেশীর নাড়ানোর জন্য স্নায়ুতন্ত্রের যে সমন্বয়ের দরকার তা সেই মুহূর্তে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিংবা, হয়তো ব্যাপারটা আদৌ জটিল কিছু নয়, আবুল হয়তো রহিমার সাথে দীর্ঘদিনের এই সম্পর্কটায় হাপিয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে করেই আর রাস্তাটা আর পার হলেন না? কয়েক দশক আগেও আবুল কেন রহিমার সাথে রাস্তা পার হল না এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে জীববিজ্ঞানী এবং মনস্তত্ত্ববিদদের মধ্যে রীতিমত গন্ডোগোলই বেঁধে যেত। মনস্তত্ত্ববিদের হয়তো বলতেন,রহিমের আবেগ এবং ইচ্ছাটাই এখানে প্রধাণ কারণ, এই ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র পিছনে বংশগতিয় কারণ টেনে আনাটা হাস্যকর। ওদিকে জীববিজ্ঞানীরা হয়তো বলতেন, এর পিছনের কারণটা বংশগতিয় না হয়েই যায় না, নিশ্চয়ই সেই মুহূর্তে রাস্তা কী করে পার হতে হয় মস্তিষ্কে ধারণ করে রাখা সেই মেমরিটা ফেল মেরেছিল। জিন এর সাথে মনন এবং আচরনের সম্পর্কগুলো বের করার জন্য বেশীভাগ সময়েই বিজ্ঞানীরা মিউট্যান্ট ব্যবহার করেন।ধরুন,একটি ইদুঁর স্বাভাবিক সময়ে কীরকম ব্যবহার করে বনাম তাদের দেহে কোন বংশগতিয় পরিবর্তন ঘটালে ব্যবহারের কী পরিবর্তন ঘটতে পারে সেটার তুলনা করেই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত টানেন। আগে, গবেষণাগারের ইদুঁরগুলো যখন কোন পূর্ব-চেনা গোলকধাঁধা মধ্যে দিয়ে রাস্তা খুঁজে বের করে খাওয়া খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হত তখন সাধারণভাবেই তাকে মেমরির ব্যার্থতা বলেই ধরে নেওয়া হত (2)। আর এ কারণেই যে বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য,মনন,আচার আচরনগুলো শুধুই ‘মানবিক’, অর্থাৎ যেগুলো অন্য প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা অত্যন্ত কঠিন, কারণ মানুষের উপর মিউটেশন ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরণের জিনের এক্সপ্রেশন ঘটানো তো আর সম্ভব নয়।
তবে মনোবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রায় সাপে নেউলে সম্পর্কের দিন মনে ফুরোতে শুরু করেছে। জন বি ওয়াটসনের সেই ডজন শিশু নিয়ে করা বিখ্যাত উক্তিটার কথা তো আমরা অনেকই শুনেছি। এক ডজন সুস্থ সদ্যজাত শিশুকে বড় করার জন্য এনে দিলে তিনি এদের যে কাউকে নাকি ইচ্ছেমত ডাক্তার, উকিল,আর্টিস্ট, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পথের ভিখারী বা চোর বানিয়ে ছেড়ে দিতে পারবেন। তাদের স্বভাব, চরিত্র,রুচি,পছন্দ অপছন্দ, বুদ্ধিবৃত্তিক ট্যালেন্ট, ক্ষমতা বা বাপ-দাদার ইতিহাস কিছুই এখানে ব্যাপার নয়, উনি এ সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে, শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নাকি এদের ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারবেন (৩)। বিহেভিয়ারিস্ট সাইকোলজির প্রবক্তা বি এফ স্কিনারের সেই বিখ্যাত দাবীটিই বা কম যায় কিসে? মানুষের মস্তিষ্ক নাকি ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ ছাড়া আর কিছু নয়, এর পিছনে কোন বংশগতিয় বাধ্যবাধকতা নেই, আমাদের মনন এবং ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্রই অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে শৈশবের অভিজ্ঞতা দ্বারাই নির্ধারিত হয়। আবার ওদিকে নেচারিস্টদের মুখেও অহরহ শোনা যেত যে মানবিক গুণাবলীগুলো প্রধাণত জিন দ্বারাই নির্ধারিত, চরম কোন পরিবেশের প্রভাব সৃষ্টি না হলে আমাদের চারপাশের অভিজ্ঞতা এগুলোর উপর নাকি কোন প্রভাব ফেলে না!
নাহ, এরকম উক্তিগুলো এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। গত প্রায় এক দেরশ’ বছরে বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারটা নিয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাগুলো পেন্ডুলামের মত এক প্রান্ত থেকে আরেক্প্রান্তে ঘোরাঘুরি করলেও এখন মোটামুটিভাবে মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে মনে করার কোন কারণ নেই যে এ নিয়ে বিতর্কের নটে গাছটি মুড়িয়েছে। বিতর্ক চলছে পুরোদমেই, তবে বিতর্কের পরিধি এখন দুই চরম প্রান্ত থেকে ক্রমশঃ মাঝখানে সরে আসতে শুরু করেছে। মস্তিষ্কের উপর গবেষণা যতই আগাচ্ছে ততই এ ধরণের চরম অবস্থানগুলোর অসাড়তা প্রমাণিত হচ্ছে। এখন পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে যে আমাদের চিন্তা ভাবনা, বুদ্ধিবৃত্তি বা ব্যবহারগুলোর উপর জেনেটিক্স এবং পরিবেশ বা সংষ্কৃতির এক জটিল মিথষ্ক্রিয়া কাজ করে, এরা একে অপরকে অনবরতভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।
এ বিষয়টির উপর যমজ শিশুদের নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। এগুলো থেকে ক্রমশঃ পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে যে কিছু বৈশিষ্ট্যের পিছন জিনের প্রভাব প্রবল আবার অন্যগুলোর উপর ততটা প্রবল নাও হতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবেশও আসলে বিশাল ভূমিকা রাখে। সদৃশ এবং অসদৃশ (আইডেন্টিকাল এবং নন-আয়ডেন্টিকাল) যমজদের উপর গত কয়েক দশকে প্রচুর কাজ হয়েছে এ নিয়ে। এই গবেষণাগুলো থেকে যা বোঝা যেতে শুরু করেছে তা কিন্তু বেশ মজার। যেমন ধরুন, আমাদের ব্যক্তিত্বর তুলনায় বুদ্ধিমত্তার উপর নাকি জিনের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, শতকরা ৫০ ভাগ সরাসরি জিনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও বাকি অর্ধেকের উপর পরিবেশের বেশ কড়া প্রভাব রয়েছে (৪)। মধ্যবিত্ত পরিবারে যমজ শিশুদের একজন বড় হলে, দরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া আরেক যমজ ভাই বা বোনের তুলনায় তার বুদ্ধিমত্তা অপেক্ষাকৃত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশী থাকে। একইভাবে যমজদের একজন উচ্চবিত্ত পরিবারে এবং আরেকজন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলে কিন্তু আবার তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার তেমন কোন হেরফের দেখা যায় না। অর্থাৎ, সাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে জিন এবং পরিবেশ দুইএরই ভূমিকা থাকলেও, চরম পরিবেশে জিনের চেয়ে পরিবেশের প্রভাব কর্তৃত্ব করতে পারে। কিন্তু পরিবেশে চরম কোন পার্থক্য না থাকলে বুদ্ধিমত্তার উপর জিনের প্রভাব প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে (৪)।ব্যাপারটা অনেকটা ভিটামিনের মত। আপনার শরীরে যদি ভিটামিনের অভাব থাকে তাহলে বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক সমস্যা দিতে পারে, কিন্তু আপনি যদি সারাদিন ধরে সাপ্লিমেন্ট খেয়ে খেয়ে শরীরে শতকরা দুই চার বা পাঁচশ ভাগ ভিটামিনের সাপ্লাই দিতে শুরু করেন তাহলে কিন্তু বাড়তি কোন লাভ হবে না। অর্থাৎ, আপনার শিশু মধ্যবিত্ত স্বচ্ছলতার মধ্যে থেকে যে সুযোগ সুবিধাগুলো পাচ্ছে তা দিয়েই মস্তিষ্কের অপ্টিমাম বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশগুলো ঘটানো সম্ভব, আরও অঢেল বিলাসিতা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাড়তি কোন সুবিধা নাও দিতে পারে।
জীববিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা কগনিটিভ নিউরোসাইন্স বা কগনিটিভ স্নায়ুবিজ্ঞানে এগুলো নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দুই একটি গবেষণার উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০০২ সালে সাইন্স জারনালে প্রকাশিত একটি রিসার্চ দিয়েই শুরু করি। অনেক সময় চাপযুক্ত সংসারে বা সহিংস পরিবেশে বড় হয়েও দেখা যায় এক ভাইয়ের জীবনে এর তেমন কোন ছাপই পড়েনি। আর ওদিকে আরেক ভাইয়ের জীবন এমনই তামা তামা হয়ে গেছে যে সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করাই হয়ে উঠলো না তার। এর পিছনের সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই হিমশিম খাচ্ছেন। আধুনিক গবেষণাগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা আজকাল বুঝতে শুরু করেছেন যে, এ ধরণের জটিল সমস্যাগুলোর পিছনে ‘শুধু পরিবেশ বা শুধু জিন’ এককভাবে কাজ নাও করতে পারে। ডিউক ইউনিভার্সিটির নিউরসাইন্স সাইকিয়াট্রি এবং বিহেভিয়ারাল সাইন্সের অধ্যাপক ডঃ এ্যভশ্যলম কাস্পি এবং তার দল এ ধরণের বিষয়গুলো নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। তারা বহু বছর ধরে ছেলে শিশুদের বেশ বড়সড় একটা নমুনাক্ষেত্রের উপর একটি গবেষণা করেছিলেন। খুব চাপযুক্ত পরিবেশে অত্যাচার, নির্যাতন মধ্যে বড় হলে কোন কোন শিশু পরবর্তী জীবনে সহিংস এবং অসামাজিক হয়ে উঠলেও বাকিদের মধ্যে এর ছাপ পড়ে না কেন? তাদের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে পরিবেশের পাশাপাশি এর পিছনে একটি বংশগতিয় কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যাপারটা সংক্ষেপে অনেকটা এরকম, একটি বিশেষ জিনের ভিতরে বহুরূপতার (functional polymorphism) কারণে MAOA (Monoamine Oxidase A) নামক একটি রাসায়নিক অনুঘটকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। যে শিশুদের মধ্যে এই MAOA এর পরিমাণ বেশী থাকে তারা সামাজিক বা পারিবারিক চাপকে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে। এই গবেষণার ফলাফলটি যদি সঠিক প্রমাণিত হয় তাহলে আংশিকভাবে হলেও হয়তো আমরা বুঝতে পারবো কেন নির্যাতিত শিশুদের অনেকে সহিংস হয়ে ওঠে কিন্তু আবার অনেকে এর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয় (৫)।
ডঃ কাস্পির আরেকটি গবেষণার কথা উল্লেখ করছি। সাইন্স জারনালে প্রকাশিত এই গবেষণাটিতে উনি প্রস্তাব করেছেন যে, বিষন্নতার পিছনেও এ ধরণের জিন এবং পরিবেশের যৌথ ভূমিকা কাজ করতে পারে (৬) (নীচে তথ্যসূত্রে এই গবেষণা দুটোর এ্য্যবস্ট্রাক্টগুলো দিয়ে দিলাম, উৎসাহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন) সাইন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ডের মে/জ়ুন ২০১০ সংখ্যায় বাচ্চাদের মধ্যে লিংগ বৈষম্যজনিত ব্যবহারগুলোর কতটুকু বংশগতিয় এবং কতটুকু পরিবেশগত তা নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই গবেষণাগুলো নিয়ে এখন আর কথা বাড়াচ্ছি না, পরবর্তী পর্বগুলোতে এগুলো নিয়ে আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইলো।
এখন ‘পরিবেশবাদী’ই বলুন আর ‘জিনবাদী’ই বলুন, সবাই খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে শুরু করেছেন যে আমাদের মনন, বুদ্ধিমত্তা, আচার ব্যবহারের মত জটিল ব্যাপারগুলোর ব্যাখ্যা ‘এস্পার বা ওস্পারের’ মত সাদা কালো ব্যাপার নয়। মোরগ আবুলের রাস্তা পার হতে ব্যর্থ হওয়ার পিছনে শুধুমাত্র শারীরিক বা বংশগতিয় ব্যর্থতা ছাড়াও অন্য আরও বহুবিধ কারণ কাজ করে থাকতে পারে। মনস্তত্ত্ববিদেরাও বুঝতে শুরু করেছেন যে এক্কেবারে ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ বলতে কিছু নাও থাকতে পারে, আমাদের বেশীর ভাগ আচার, আচরণ, ব্যবহার বা কর্মকান্ডের পিছনেই সহজাত কোন বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বংশগিতয় প্রভাব থাকার সম্ভাবনা বড়ই প্রবল। তবে এখানে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। কোন আচরনের সাথে বংশগতিয় কোন বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মানেই কিন্তু বোঝায় না যে এই আচরনের পিছনের কারণটিকে চোখ বন্ধ করে ‘বংশগতিয়’ বলে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া যাবে। আমরা অনেক সময়েই বুঝি না যে ‘সম্পর্কিত’ মানেই ‘কারণিক’ নয়। আমাদের অনেক আচরণের পিছনেই হয়তো বংশগতিয় এবং পরিবেশের এক জটিল এবং সমন্বিত ফ্যাক্টর কাজ করে। বংশগতিয় ফ্যাক্টরগুলোর সাথে মনোযোগ, তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের করার জন্য স্নায়বিক সমন্বয়, পরিবেশ, সংষ্কৃতি বা এপিজেনিটিক প্রভাবসহ এক জটিল পদ্ধতির জাল কাজ করতে পারে।
আজকাল প্রায়শঃই পত্রিকা খুললেই দেখা যায় বিজ্ঞানীরা নাকি ‘মাদাষক্ততার জিন’ খুঁজে পেয়েছেন বা ‘গে জিন’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন বলে ফলাও করে খবর ছাপা হয়েছে। আর ওদিকে তো পপ বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের খবরের যেন কোন অন্ত নেই, আজ হয়তো ছাপা হচ্ছে মেয়েদের মেয়েলি হওয়ার বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা, কাল হয়তো পাওয়া যাচ্ছে কেন মেয়েদের মস্তিষ্ক অংক এবং বিজ্ঞান ধারণ করতে সক্ষম নয় তার ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’। এভোলিউশানারী ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজির অন্যতম গবেষক শন ক্যারল এগুলো নিয়ে সাবধান করতে গিয়ে বলেছিলেন, এখন যেহেতু আমরা মোটে FOXP2 বা MYH16 এর মত জিনগুলোর কথা জানতে শুরু করেছি আমাদের এ প্রসঙ্গে অনেক বেশী সাবধাণতা অবলম্বণ করা প্রয়োজন। এ ধরণের কোন একটা আবিষ্কারকে মানুষের বিবর্তনের বা কোন একটা বৈশিষ্ট্যের ‘সব-রহস্য-সমাধানকারী’ কারণ বলে অভিহিত করার যে স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে তা বন্ধ করা একান্তভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। একদিকে ফসিলবিদ এবং নৃতত্ববিদেরা যেমন বুঝতে শুরু করেছেন যে আমাদের বিবর্তন কোন সরল এক রৈখিক পথে ঘটেনি ঠিক তেমনি স্নায়ুবিজ্ঞানীরাও পরিষ্কারভাবে বুঝতে শুরু করেছেন যে আমাদের আচার ব্যবহার বা বুদ্ধিবৃত্তির পিছনের কারণগুলো অনেক গভীরে প্রথিত। আমাদের ‘মানবীয় ক্ষমতাগুলোর’ মূল কার্যকরণ বা উৎপত্তি আমাদের মস্তিষ্কের কোন ‘এনাটিমিকাল ল্যান্ডমার্কের’ সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।আমাদের দ্বিপদী হয়ে ওঠা, মস্তিষ্কের আকার বড় হওয়া বা গঠন, ভাষা শেখার মত ক্ষমতাগুলো সম্ভবত ‘কয়েকটা’ জিনের উপর নির্ভরশীল নয় (4)। এমনও হয়তো হতে পারে যে মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো, বিশেষ করে আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলোর পিছনে একটি নয় দুটি নয় শ’য়ে শ’য়ে জিনের হাত রয়েছে। শুধু তো তাইই নয়, তার উপর আবার রয়েছে পরিবেশের প্রভাব। বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থার উপর ভিত্তি করে এই জিনগুলোর এক্সেপ্রেশনও আবার বদলে যেতে পারে।
আমরা এ নিয়ে এখনো অনেক কিছুই জানি না। কিন্তু গত দশকের এই গবেষণাগুলো থেকে ইতোমধ্যেই কতগুলো ব্যাপার ক্রমশঃ পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ‘জিন না পরিবেশ’ বা ‘প্রকৃতি বনাম সংষ্কৃতি’ ধরণের প্রশ্নগুলো গোড়াতেই গলদ রয়ে গেছে। প্রকৃতি বেশী গুরুত্বপূর্ণ নাকি পরিবেশ বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মনে হয় অনেকটা ‘নারী বেশী ভালো নাকি পুরুষ বেশী ভালো’ ধরণের প্রশ্নের মত। পরিবেশ ছাড়া যেমন প্রকৃতি সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি প্রকৃতির সাথে পরিবেশের সাথে মিথষ্ক্রিয়া ব্যতীত আমাদের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটার গুরুত্ব পরিমাপ করাও সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞান যতই আগাচ্ছে ততই আমরা আরো বেশী করে বুঝতে শুরু করেছি যে মানুষের মন এবং মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পর্কে জানতে হলে ‘কোনটি ভালো’ নয় বরং জিজ্ঞাস্যটা হতে হবে ‘কীভাবে’, জিজ্ঞেস করতে হবে মস্তিষ্ক এবং চেতনার বিকাশে আমাদের সহজাত বংশগতীয় বৈশিষ্ট্যগুলো তার চারদিকের পরিবেশের কীভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে।
ম্যাট রিডলী তার ‘অ্যজাইল জিন’ বইটিতে এ নিয়ে চমৎকার কিছু আলোচনা করেছেন। রিডলীর আমার খুব পছন্দের লেখক হলেও তার সাথে দ্বিমত হয় হরহামেশাই। তা তে যে রিডলীর মত বড় লেখকের কিছু এসে যায় তা নয়, কিন্তু আমার বড়ই উপকার হয়। তার বক্তব্যের সাথে দ্বিমতের কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে আরো অনেকগুলো বই পড়ে ফেলি, কিন্তু সে কথা আপাতত তোলা থাক। উনি অ্যজাইল জিন বইটিতে একদিকে জিনের সহজাত পূর্ব-নির্মিত গঠন প্রবৃত্তি এবং আরেকদিকে এর স্থিতস্থাপকতা এবং নমনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেই সাথে দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিবেশ, পরিস্থিতি বা সংষ্কৃতির ছোঁয়া কিভাবে আমাদের বংশগতীয় ছাঁচগুলোকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপে গড়ে তোলে বা প্রভাবিত করে। বইটি তিনি শেষ করেছেন এই বলে, “জিন হচ্ছে সংবেদনশীলতার প্রতীক, জিন আমাদের নমনীয়তা এবং অভিজ্ঞতার ভৃত্য হওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতি বনাম পরিবেশ বিতর্কের দিন ফুরিয়েছে, পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি টিকে থাকুক বহুকাল” (৮)।
সে যাক, এবার মস্তিষ্ক নিয়ে মূল আলোচনায় ঢোকা যাক। লেখাটিকে আপাতত তিনটি প্যরাডক্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। ভবিষ্যতে বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে লিখতে শুরু করলে এর পরিধি হয়তো আরও বাড়াতে হতে পারে। এই তিনটি প্যারাডক্সের আলোচনা করতে গেলে ঘাড় টানলে মাথা আসার মত অনেক প্রাসংগিক আলোচনাও হয়তো চলে আসবে। মস্তিষ্কের গঠন এবং বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়েও আলোচনা করতে হবে। চলুন শুরু করা যাক,
প্যারাডক্স নম্বর একঃ মস্তিষ্ক নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়লে প্রথমেই দেখা যায় যে বেশীর ভাগ লেখকই মানুষের মস্তিষ্ক কত অভিনব এবং কত বিষ্ময়কর তা নিয়ে আলোচনা করেন। কথাগুলোর মধ্যে একেবারেই যে সত্যতা নেই তা নয়। পৃথিবীতে অন্যান্য প্রাণীর বুদ্ধিবৃত্তি এবং মননের সাথে তুলনা করলে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মকান্ডকে ‘অভিনব’,’নভেল’ জাতীয় বিশেষণে ভূষিত করাটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এই বিষ্ময়কর বুদ্ধিবৃত্তি এবং মনন-ক্ষমতা যে মস্তিষ্কের ফসল সেটার গঠন সম্পর্কেও কী একই বিশেষণগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব? আমাদের দেহের সর্বোচ্চ কুঠরীতে অবস্থান করা তিন পাউন্ডের এই অংগটির গঠন আসলেই কী অভিনব কোন প্রকৌশলগত নৈপূন্য প্রকাশ করে? নাকি আমাদের অন্যান্য অংগের মতই এই মস্তিষ্কটিও কোটি কোটি বছরের বিবর্তনীয় জোড়াতালির সাক্ষ্য বহন করে?
চোখের গঠন নিয়েও আমরা কিন্তু সৃষ্টিবাদীদের কাছ থেকে একই ধরণের বক্তব্য শুনে অভ্যস্ত, চোখের মত একটি সুগঠিত এবং ‘অভিনব’ অংগ নাকি কোনভাবেই বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠতে পারে না! মুক্তমনাতেই আইডি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি মানুষের চোখের গঠন মোটেও নিঁখুত কোন প্রকৌশগত বা কারিগরী বিষ্ময় নয় বা এর মধ্যে উৎকর্ষের পূর্ণমাত্রার কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় না। চোখের গঠন বেশ জটিল হলেও সেটিও কিন্তু দেহের অন্যান্য অঙ্গের মতই দীর্ঘকালের বিবর্তনের ‘প্যাচ-ওয়ার্কের’ই ফসল। আমি আমার লেখায় দেখানোর চেষ্টা করবো যে, আমাদের মস্তিষ্কের গঠন সম্পর্কেও একই কথাই প্রযোজ্য। তাহলে এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে, আমাদের মস্তিষ্কও যদি বিবর্তনীয় পথে এমন জোড়াতালি দিয়েই তৈরি হয়ে থাকে তাহলে আমরা কীভাবে এমন অভূতপূর্ব বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী হতে পারলাম? যার গঠনে এমন জোড়াতালি তার কম্ম কী করে এত ‘মহান’ হওয়া সম্ভব? হ্যা, এই প্যারাডক্সটা নিয়েই আলোচনা করতে চাই এর পরের পর্বের লেখাটায়।
প্যারাডক্স নম্বর দুইঃ দ্বিতীয় প্যারাডক্সটিও বেশ জটিল। একটি গবেষণায় যদি দেখানো হয় যে, নবজাত মানব শিশু সহজাত বেশ কিছু বুদ্ধিবৃত্তি নিয়েই জন্মায়, মস্তিষ্ক মোটেও ‘ব্ল্যাক স্লেট’ নয় এর পরেই আবার আরও দুটো গবেষণার কথা শোনা যায় যেখানে এর উলটো কথা শোনা যায়। দেখানো হয়, আমাদের আচার আচরন, ব্যবহারের অনেক কিছুই বদলানো সম্ভব বা অনেক সময় বিভিন্ন কারণে মস্তিষ্কের গঠন বদলে দিলেও আমরা দিব্যি অনেক নিত্য নৈমিত্তিক কাজ চালিয়ে যেতে পারি। আজকালকার বহু গবেষণাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মস্তিষ্ক দিয়ে আমরা যেমন পরিবেশের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করি, মস্তিষ্কই যেমন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি এবং সহজাত চেতনার আধার, ঠিক তেমনিভাবে পরিবেশও আবার মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম। জন্মের পরে আমাদের মস্তিষ্ক চারপাশের পরিবেশ থেকে অনেক কিছুই শিখতে সক্ষম। কিন্তু তাহলে এখন স্বভাবতই প্রশ্ন করতে হয়, আমাদের মস্তিষ্কের গঠন যদি এতটাই সহজাত বা ‘ইনেট’ হয়, তাহলে আবার এর মধ্যে এতখানি স্থিতিস্থাপকতা বা নমনীয়তা থাকাটা কীভাবে সম্ভব? একই জিনিসের যুগপৎভাবে কঠিন এবং নমনীয় হওয়া সম্ভব কী করে? মস্তিষ্ক এবং চেতনার নিয়ে লিখতে গেলে আজকাল আর এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এই প্রশ্নটিকে এই শতাব্দীতে জীবিবিজ্ঞানের অন্যতম একটি জটিল প্রশ্ন হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। আমরা যে এই প্যাডক্সটির সবটুকু বুঝি তা নয় তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু বুঝি তা নিয়েই আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো দ্বিতীয় পর্বে।
প্যারাডক্স নম্বর তিনঃ এবার আসি শেষ প্যারাডক্সটিতে। আসলে মস্তিষ্ক নিয়ে আলোচনার চ্যালেঞ্জটাই এই জায়গাটিতে, আপনি যা নিয়েই আলোচনা করতে চান না কেন, পদেপদে বেশ কিছু জটিল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আগাতে পারবেননা। যাই হোক, আমি এর পরে যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাই তা হল, আমরা এই একুশ শতাব্দীতে পা দিয়ে জেনেছি যে, আমাদের ডিএনএতে মাত্র ২৩-২৫ হাজার জিন রয়েছে। এই ‘জিন শর্টেজ’ বা ‘জিনের স্বল্পতা’ নিয়ে আমি আমার এভো ডেভো লেখাটায় বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। পরিবেশবাদীরা প্রায়শঃই এই ব্যাপারটা নিয়ে হইচই করেন, বলেন, মাত্র ২৩ হাজার জিন দিয়ে কোনভাবেই আমাদের মস্তিষ্কের সব কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাদের কথাটা সম্পূর্ণভাবে সঠিক না হলেও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতও কিন্তু নয়। আসলেই তো, চিন্তা করে দেখুন, আমাদের মস্তিষ্কের এক শ’ কোটি (এক বিলিয়ন) নিউরন এবং প্রায় পাঁচ শ’ হাজার কোটি (৫০০ ট্রিলিয়ন) সিন্যাপ্সের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। caenorhabditis elegans নামক ছোট্ট এবং প্রায় ‘বোধ-বুদ্ধিহীন’ (অনেকে বলবেন মানুষের সাথে তুলনা করলে এদেরকে তো বোধ বুদ্ধিহীন বলাটাই সমীচীন হবে) কৃমিটির ৩০২ টি নিউরন এবং প্রায় ৭৮০০ সিন্যাপ্সের হিসেব রাখার জন্য যদি প্রায় ১৯ হাজার জিনের প্রয়োজন হয় তাহলে মাত্র ২৫ হাজার জিন দিয়ে কী করে আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণের কাজটি করা সক্ষম? এই প্রশ্নটির উত্তরে মধ্যেই বোধ হয় আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।
এই প্রশ্নটির উত্তর সঠিভাবে দিতে পারলে মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতার মাত্রা নিয়ে সমস্যাটারও হয়তো আংশিক সুরাহা হতে পারে। এ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসংগেরও অবতারণা করতে হবে। আমরা প্রায়শঃই বিজ্ঞানের সাহিত্যের বইগুলোতে ডিএনএ কে ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে উল্লেখ করতে দেখি। আমাদের জিনোম কী আসলেই একটি ব্লুপ্রিন্ট? এভাবে ডিএনএ কে ব্লুপ্রিন্ট বলাটা শুধু একটি ভুলই নয়, একটি মারাত্মক ভুল। এই ধারণাগত ভুলটি থেকে বেশ কিছু ভুল ধারণার জন্ম নিতে পারে। এই বেসিক ব্যাপারগুলো পরিষ্কারভাবে না বুঝলে মস্তিষ্কের কর্মকান্ডের মত জটিল বিষয়গুলো তো দূরের কথা প্রাণের বিবর্তন নিয়েই সঠিক ধারণাটা অর্জন করা সম্ভব নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন